সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ১২:৪৮ অপরাহ্ন

ভাড়ার টাকায় চলতে পারবে না মেট্রোরেল

ভাড়ার টাকায় চলতে পারবে না মেট্রোরেল

স্বদেশ ডেস্ক:

দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হচ্ছে চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর। সে প্রস্তুতি নিয়েই জাইকার সহায়তায় এগিয়ে চলছে নির্মাণকাজ। উদ্বোধনকালে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর কথা রয়েছে। নির্মাণকাজের পাশাপাশি এখন চলছে ভাড়া নির্ধারণ ও পরিচালনসংক্রান্ত প্রস্তুতি।

দেরিতে হলেও মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের উপলব্ধি, কেবল ভাড়ার টাকা দিয়ে মেট্রোরেল পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই নির্মাণ করতে হবে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট হাব ও স্টেশন প্লাজা। বাণিজ্যিকভাবে জায়গা ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মেটানোর চেষ্টা করা হবে। এ ছাড়া চালুর শুরুর দিকে লাভের বদলে লোকসান গুনতে হবে। তাই মেট্রোরেল কোম্পানির অধীনে চললেও সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, টাকার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এর মাধ্যমে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক দশক পর এসে রেললাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ানোসহ নতুন কিছু কাজ যোগ করতে চায় ডিএমটিসিএল। এ ছাড়া বাড়তি আয়ের জন্য নতুন করে স্টেশন প্লাজা ও ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) করতে চায় সংস্থাটি। যাত্রীদের টিকিটের মূল্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিপণিবিতান করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মেট্রোরেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহনের

সুবিধার্থে গড়ে তোলা হবে টিওডি হাব। এরই ধারাবাহিকতায় এমআরটি ৬-এর উত্তরা সেন্টার স্টেশনসংলগ্ন জমিতে নির্মাণ করা হবে টিওডি হাব। তাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে ২৮.৬১৭ একর ভূমি বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে এজন্য লে-আউট প্ল্যান প্রস্তুতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম টিওডি হাব। এ ছাড়া বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট মোড ব্যবহার করে যাত্রীদের মেট্রোরেল স্টেশনে আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ক্রমান্বয়ে থাকবে স্টেশন প্লাজা।

প্রাথমিকভাবে উত্তরা উত্তর, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় থাকবে স্টেশন প্লাজা। শুধু তাই নয়, প্রতিটি স্টেশনের কনকোর্স লেভেল-জিতে বাণিজ্যিক স্থান রাখা হবে। টিওডি হাব সরকারি অর্থায়ন, পিপিপি বা অন্য কোনো উৎসের ভিত্তিতে করা হতে পারে। ২০২১ সালের ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর জাইকার মিশনের টিম ঋণের ব্যাপারে আলোচনা করে এ ইস্যুতে। এ পরিস্থিতিতে জাইকার মাধ্যমে টিওডি হাব স্থাপনের মাস্টারপ্ল্যান, ডিজাইন ও ব্যয় প্রাক্কলনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করবে সরকার। গত ৩১ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএএন ছিদ্দিক বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের শুরুতে নতুন করে রুট নির্ধারণ করা গেছে। এ ছাড়া নানা যৌক্তিক কারণে খাত ও ব্যয় বেড়েছে। এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে।

জানা গেছে, এমআরটি লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। ৬টি কোচ সংবলিত প্রতিটি একমুখী মেট্রো ট্রেন প্রতিবারে ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনে থেমে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এতে অল্প সময়ে অধিক সংখ্যায় যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ তাদের পরিচালনা ব্যয় মেটাতে টিওডি হাবসহ বিভিন্ন স্থাপনার যুক্তি দিচ্ছে নতুন করে। এখন বলছে, ভাড়া দিয়ে পরিচালন ব্যয় বহন সম্ভব নয়। তাই নানা খাত দেখিয়ে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ টাকা। তবে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বলছে, ‘পূর্বের ডিপিপিতে কেন টিওডি এবং স্টেশন প্লাজার সংস্থান রাখা হয়নি’। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে জানতে চাওয়া হলে ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে সম্প্রতি জবাব দেওয়া হয়েছে।

সেখানে বলা হয়, ২০১১ সালের জাইকার প্রিপারেটরি স্টাডি রিপোর্টে বিষয়টি বাদ পড়ে। সে সময় তিনটি ধাপে মেট্রোরেল করার প্রস্তাব ছিল। প্রথমত পল্লবী থেকে সোনারগাঁও অংশ ১১ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপ সোনারগাঁও থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৪.৪ কিলোমিটার, তৃতীয় ধাপ পল্লবী থেকে উত্তরা তৃতীয় পর্ব ৪.৭০ কিলোমিটার। ওই স্টাডিকালে রাজউকের উত্তরা তৃতীয় আবাসিক প্রকল্পের ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান চূড়ান্ত ও নির্মাণ সময় নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে পল্লবী থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত অংশ প্রথম ধাপে বাস্তবায়নের মত আসে। সে অনুযায়ী পল্লবী স্টেশনকে টার্মিনাল স্টেশন বিবেচনায় নিয়ে স্টেশন প্লাজা এবং পল্লবী থেকে মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ১.৩০ কিলোমিটার দূরে ডিপো নির্মাণের প্রস্তাব করে। সাধারণত টার্মিনাল স্টেশনে আবশ্যিকভাবে স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করা হয়ে থাকে। স্টাডি রিপোর্টে স্টেশন প্লাজাকে ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে গণপরিবহন চলাচলের সংযোগ ও বাণিজ্যিক স্থাপনার মাধ্যম, বাস বে, সিএনজি বে ও রিকশা বে এবং পার্ক ও রাইডের বিষয়টি বিবেচনায় রাখে।

মেট্রোরেল অ্যালাইনমেন্ট বরাবর কোন স্টেশনে কোন ধরনের স্টেশন প্লাজা থাকবে তা ওই রিপোর্টে বলা আছে। কিন্তু জাইকার সার্ভে টিমের প্রতিবেদনে অ্যালাইনমেন্ট বরাবর স্টেশন প্লাজা নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য ভূমির অবস্থান ও পরিমাণ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাইকা মিশন থেকে ভাড়া ব্যতীত আয় বৃদ্ধির জন্য টিওডি হাবসহ অন্য সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। এরই ধারাবাহিকতায় পরে রাজউক থেকে ভূমি বরাদ্দ নেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্টেশন প্লাজার জন্য উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, পল্লবী, আগারগাঁও এবং ফার্মগেট মেট্রোস্টেশনকে স্টেশন প্লাজার জন্য নির্বাচন করে জাইকা। দাতা সংস্থাটি পরামর্শকের মাধ্যমে বিস্তারিত নকশা এবং চলমান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্টেশন প্লাজাগুলো নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া সাধারণ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টিওডি হাব নির্মাণে বেসিক ডিজাইনের প্রস্তাব করে জাইকা। আর ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বরের চিঠিতে স্টেশন প্লাজাসহ ফুটপাত প্রশস্ত করতে ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবে একমত পোষণ করে। সে অনুযায়ী জাইকা অ্যাপরাইজাল মিশন প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলনের সময় ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রাক্কলন চূড়ান্ত করে। মূল ডিপিপি ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রস্তুত করা হয় জাইকার এমওডির ওপর ভিত্তি করে। তখন ডিপোর জন্য ভূমি অধিগ্রহণ বিবেচনায় খরচ ধরা হয় ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু একই এমওডিতে স্টেশন প্লাজা নির্মাণের বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য না থাকায় তা বাদ পড়ে। একইভাবে টিওডি হাবের বিষয়টি বাদ পড়ে সে সময়। এমআরটি লাইন ৬-এর মূল ডিপিপি অনুমোদনের পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। সে কারণে পরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তৃতীয় ধাপের অংশের অ্যালাইনমেন্ট রিভিউ করে চূড়ান্ত এবং ডিপোর অবস্থান পল্লবী থেকে বাদ দিয়ে উত্তরা তৃতীয় পর্ব এলাকায় নির্দিষ্ট করে। সে অনুযাযী করা হয় ডিপো। পরবর্তী সময়ে যাত্রীদের লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়িতে নিরাপদে যাত্রী উঠানামা এবং পথচারীদের সুবিধার্থে ফুটপাত করা হচ্ছে। তা ছাড়া স্টেশন প্লাজা নির্মাণ ও ‘নন-ফেয়ার রেভিনিউ’ আয় হিসেবে টিওডি হাব নির্মাণে সার্ভে, লোকেশন, ভূমির সংস্থান ও ডিজাইনের কাজ শুরু হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, মেট্রোরেল পরিচালনায় ভাড়ার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪০ পয়সা প্রস্তাব করা হলেও জনগণের ‘সুবিধার্থে’ ভাড়ার হার পুনঃনির্ধারণের কাজ চলছে। তা ছাড়া লিখিতভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে ভাড়ার টাকায় মেট্রোরেল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহন সম্ভব নয়। তাই টিওডি হাব ও স্টেশন প্লাজা নির্মাণের দিকে হাঁটছে। তদুপরি মেট্রোরেল চালু হলে লোকসান কমানো সম্ভব নয়। তাই ১ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করেছে ডিএমটিসিএল। যদিও সাম্প্রতিক পৃথক বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘টিকিট থেকে সম্ভাব্য আয় কত হবে, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কত হবে তার আগাম তথ্য জানা দরকার’। বাণিজ্যিকভাবে মেট্রোরেল চলাচলের পরও কেন ১ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে এবং সেই টাকা অনুদান, ভর্তুকি না ইকুইটি হিসাবে চাওয়া হয়েছে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জানতে চেয়েছে মন্ত্রণালয়।

ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। তবে সরকার এখন মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে চায়। কাজটির জন্য খরচ হবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়াতে চায় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। মেট্রোরেলের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় ছয় একর জমি নতুন করে অধিগ্রহণ করতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877